নামকরণ :মেঘনার ললাটে সাগরের টিপ-দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ। তিন সহস্রাধিক বৎসরের প্রাচীন এই দ্বীপের নাম করণের বিষয়ে অনেক কিংবদমিত্ম প্রচলিত থাকলেও সর্বাধিক গ্রহনযোগ্য মতটি হচ্ছে-আদিতে এটি ছিল চারিদিকে অথৈ জলরাশি পরিবেষ্টিত একটি বিরাট ’’বালিরসত্মূপ’’- ইউরোপীয়দের ভাষায় ‘‘স্যান্ডহিপ’’ ‘‘Sandheap” । কালক্রমে এই ‘‘স্যান্ডহিপ’’ শব্দটি থেকেই সাগর কন্যার নাম হয়েছে ‘‘সন্দ্বীপ’’। কথিত আছে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বারজন আউলিয়া বাগদাদ হতে মৎস্য পৃষ্ঠে আরোহণ করে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য রওয়ানা হন। পথে নামাজের সময় হয়। কোথায় নামাজ পড়বেন এই চিন্তা উদয় হওয়া মাত্রই তাঁরা একটা দ্বীপ দেখতে পান। সমুদ্রের মাঝে একমাত্র দ্বীপ বলে একে তারা ‘‘শুন্যদ্বীপ’’ আখ্যা দেন। এই শুন্যদ্বীপই আজকের সন্দ্বীপ। কালের বিবর্তনে এটি শুন্যদ্বীপ বা সন্দ্বীপ এ পরিবর্তিত হয়। সন্দ্বীপ নাম উৎপত্তির আরও বহু ধারণা পাওয়া যায়। কেউ কেউ মনে করেন, ইউরোপীয়রা যখন এদেশে আসেন তখন সন্দ্বীপ বালির সত্মূপের মত দেখাতো বিধায় তাঁরা একে তাঁদের মাতৃভায়ায় ‘‘Sandheap” বা বালির স্ত্তপ বলেছিলেন। উক্ত ‘‘Sandheap” হতে পরিবর্তিত হয়ে সন্দ্বীপ নামের সৃষ্টি হয়। বাখরগঞ্জের ইতিহাস লেখক বেভারেজ সাহেব সোমদ্বীপ হতে সন্দ্বীপ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে উলেস্নখ করেছেন। আবার কেউ কেউ দ্বীপের উর্বরতা ও প্রাচুর্যের কারণে দ্বীপটিকে স্বর্ণদ্বীপ আখ্যা প্রদান করেন। উক্ত স্বর্ণদ্বীপ হতে সন্দ্বীপ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেও ধারণা করা হয়।
সন্দ্বীপের অবস্থান ও সীমানা : কালের বিবর্তনে সন্দ্বীপের বর্তমান দৈর্ঘ্য ১৮-২০ ও প্রস্থ ৭-৮ মাইলের অধিক হবে না। অথচ এককালে এর সীমা বহুদুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সন্দ্বীপের পশ্চিম-দক্ষিণে ছিল শাহবাজপুর, পূর্বে ও উত্তরে ছিল বিক্রমপুরের দক্ষিণ এবং বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বকোণে সন্দ্বীপের অবস্থান। আর এখানে থেকে চট্টগ্রাম উপকূলের সীতাকুন্ডের দূরত্ব প্রায় দশ মাইল। নোয়াখালীর মূল ভূখন্ড সন্দ্বীপ থেকে প্রায় ১২ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। হাতিয়া সন্দ্বীপ থেকে প্রায় বিশ মাইল দুরে অবস্থিত। সন্দ্বীপ ২২.২২র্ থেকে ২২.৩র্ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১.২৬র্ থেকে ৯১.৩৪র্ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যমত্ম বিসত্মৃত। সন্দ্বীপের সীমানা হচ্ছে উত্তরে বামনী নদী এবং পশ্চিমে মেঘনা নদী ও তৎপশ্চিমে হাতিয়া দ্বীপ, পূর্বে সন্দ্বীপ চ্যানেল এবং চ্যানেলের পূর্ব পাড়ে চট্টগ্রাম এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যঃ প্রাকৃতিকভাবে দূর্যোগ কবলিত সন্দ্বীপ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যে অপরূপ। মোঘল যুগে ১৫৮২ সালে তৎকালীন বঙ্গদেশকে ১৯টি প্রদেশে বিভক্ত করা হলে তাতে মহাল বা পরগনার সংখ্যা ছিল ৬৮২ টি। তন্মধ্যে সন্দ্বীপ ছিল একটি মহাল বা পরগনা। সন্দ্বীপ, হাতিয়া, বামনী ও সাগরদিহি নামক দ্বীপ চতুষ্টয়ের সমন্বয়ে গঠিত হয় সন্দ্বীপ পরগনা। আর ফতেয়াবাদ নামক সরকারের অমত্মর্ভূক্ত ৩১টি মহাল বা পরগনার মধ্যে সন্দ্বীপও ছিল। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সন্দ্বীপ থানা নোয়াখালী জিলার অধীনে ছিল। ১৯৫৪ সালে সন্দ্বীপ চট্টগ্রাম জেলার অমত্মর্ভুক্ত হয়। সিকস্তি পয়স্তি, জোয়ার-ভাটা, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস সাগর কন্যা’ সন্দ্বীপের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। বিশেষ করে প্রতিবছর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যমত্ম ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, অতিবৃষ্টি ইত্যাদি কারণে সর্তক সংকেত লেগেই থাকে। কিন্তু উত্তাল সাগরের অব্যাহত ভাঙ্গনের কারণে বর্তমানে তা ৮০-৯০ বর্গমাইলে এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে একটি পৌরসভা ও ১৫টি ইউনিয়ন রয়েছে। ২০১১ সালে আদমশুমারী অনুযায়ী লোক সংখ্যা ২,৭৮,৬০৫ জন।
আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের ভাষায় ‘‘চন্দ্রশেখর পর্বত হইতে দক্ষিণে দৃষ্টি ফেরাইলে অনমত্ম দিকচক্রবাল সন্দ্বীপকে ব্যাবিলনের শূন্যোদ্দ্যানের মত প্রতীয়মান হইবে’’। হাজার বছরের সভ্যতার লীলাভূমি সন্দ্বীপে বহু ক্ষণজন্মা পুরুষ জন্মগ্রহন করেছেন। এ সন্দ্বীপ জন্ম দিয়েছে কমরেড মুজফ্ফর আহমদের মতো রাজনীতিবিদ, ভাষাসৈনিক রাজকুমার চক্রবর্তীর মতো দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান ও মাওলানা অজিউল্লাহর মতো মেধাবী আলেম, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামী আবু তোরাব চৌধুরীর মতো বীরযোদ্ধা, চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের সাহসী সৈনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের কৃতি ছাত্র বিপস্নবী লালমোহন সেন, আলীয়া নেছাবের মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা খানবাহাদুর মাওলানা জিয়াউল হক, মৌলভী বছির উদ্দীন এর মতো গর্বিত সন্তান। বাংলা ভাষা চর্চায় ও সন্দ্বীপের রয়েছে অসামান্য ভূমিকা। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ রচয়িতাদের মাঝে স্থান করে নিয়েছিলো আমাদের মীননাথ, সপ্তদশ শতাব্দীতে মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে সাহসী উচ্চারণ করেছিলেন আমাদেরই একজন কবি আবদুল হাকিম। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ফ্রন্ট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রধান সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ, বেতারের প্রথম কণ্ঠস্বর আবুল কাশেম সন্দ্বীপী এবং ঐ বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ১১ জনের মধ্যে ৩ জনই সন্দ্বীপের গর্বিত সন্তান। দেশবরেণ্য শিশুসাহিত্যিক আফলাতুন এবং বর্ষীয়ান চিত্রশিল্পী অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় এ সন্দ্বীপের অহংকার। বর্তমানে প্রজাতন্ত্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যেও রয়েছে উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক যোগ্যতাসম্পন্ন, দায়িত্বশীল সন্দ্বীপ- সন্তান।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস